আসসালামু আলাইকুম। আজকের টপিক হচ্ছে GPS। এটি কিভাবে কাজ করে এবং এর মাধ্যমে মানুষ যেসব সুবিধা ভোগ করতে পারে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
অতীতে অবস্থান নির্ণয়ের জন্য নানা রকমের ঝামেলা পোহাতে হতো। মানচিত্র কম্পাস বা স্কেল দিয়ে মেপে সঠিক অবস্থান বের করাটা ছিল প্রায় অসাধ্য। অথচ বর্তমানে আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোন দিয়ে সহজেই এই কাজটি করা যায়। আর সেজন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তাকে GPS বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বলা হয়। বাংলায় একে বলা যায় বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণায়ক ব্যবস্থা। বর্তমান কালের আধুনিক বিশ্ব যে কতটা GPS নির্ভর তা হয়ত আমরা ভেবেও দেখিনি। আজকের টপিকে GPS সম্পর্কে আলোচনা করা হবে৷
GPS প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হয়েছিল মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে। প্রথমদিকে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র গুলোতে জিপিএস ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে সাধারণ মানুষই এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। এই ব্যবস্থায় মূলত কতগুলো স্যাটেলাইট বা কুত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে সমগ্র পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করে গ্রাহকের সুবিধামতো তার অবস্থান জানানো হয়। সহজ করে বলতে গেলে মনে করুন আপনি কোথাও বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গেছেন। এখন আপনাকে বলা হল আপনি ঢাকা থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে আছেন। কিন্তু ঢাকা থেকে কোন দিকে ৩২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছেন। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ কিছু জানা নেই। এরপর আপনাকে বলা হলো আপনি চিটাগং থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে আছেন। তারপরও আপনার অবস্থান বোঝা সহজ হলো না। কিন্তু এরপর যদি বলা হয় আপনি কক্সবাজার থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে আছেন। তখন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে কারণ এই তিন জায়গার দূরত্ব যে বিন্দুতে ছেদ করে আপনি নিশ্চয়ই সেখানে আছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে আপনি ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে উল্লেখিত দূরত্বে বান্দরবানে আছেন। এভাবে হিসাব করাকে বলা হয় Trilateration।
স্যাটেলাইট ব্যবহার করে অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ এবং উচ্চতা এই তিনটি বিষয় জানার মাধ্যমে কোন স্থানের যথার্থ অবস্থান নির্ণয় করা যায়। তিনটি অবস্থানের সম্মিলিত বিন্দুকে বলা হয় Coordinate point। পৃথিবীর দুইটি জায়গার নাম একটি হতে পারে কিন্তু তাদের কো-অর্ডিনেট পয়েন্ট কখনই এক হতে পারে না। সে কারণেই স্যাটেলাইট এর সাহায্যে যথার্থ এবং নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
সমগ্র পৃথিবীকে GPS ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে ত্রিশটি স্যাটেলাইট সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে। তবে এই সেবা নিশ্চিত করতে চব্বিশটি স্যাটেলাইট এর দরকার হয়। কোন একটি স্যাটেলাইট হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেলে জিপিএস ব্যবস্থা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য বাকি ছয়টি স্যাটেলাইট ব্যাকআপ হিসেবে রাখা হয়েছে। GPS স্যাটেলাইটগুলো এমনভাবে সাজানো যাতে করে যেকোনো মুহূর্তে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের অবস্থান নির্ণয় করতে চারটি স্যাটেলাইট সবসময় থাকবেই। তার মানে এই মুহূর্তেও আপনি কমপক্ষে চারটি GPS স্যাটেলাইটের আওতার মধ্যে আছেন। একেকটি GPS স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘুরে আসতে 12 ঘন্টা সময় নেয় অর্থাৎ এরা দিনে দুইবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।GPS স্যাটেলাইট সব সময় এক ধরনের রেডিও সিগন্যাল বা সংকেত পাঠাতে থাকে। পৃথিবীতে থাকা GPS চিপ এসব সিগন্যাল গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়।
বর্তমান কালের সকল স্মার্টফোনে এই GPS চিপ সংযুক্ত আছে। এমনকি আজকাল স্মার্টঘড়ি, চাবির রিং, জুতা সহ নানান ধরনের সরঞ্জামে GPS চিপ এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। স্যাটেলাইট সিগন্যাল পাঠায় এবং GPS চিপ সিগন্যাল গ্রহণ করে। এখন প্রশ্ন হল এর মাধ্যমে অবস্থান কিভাবে নির্ণয় হয়। বিষয়টি বুঝতে হলে সিগন্যাল আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে।
স্যাটেলাইট যখন সিগন্যাল পাঠায় এবং রিসিভার যখন সিগন্যাল গ্রহণ করে সেই দুটি সময় লিপিবদ্ধ করা হয়। সিগন্যাল প্রেরণের এবং সিগন্যাল গ্রহণের মধ্যবর্তী এই সময় দিয়েই দূরত্ব পরিমাপ করা হয়। এসব রেডিও সিগন্যাল সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ে তিন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। অর্থাৎ স্যাটেলাইট থেকে আপনার স্মার্টফোনের সিগন্যাল আসতে এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগে। অতিক্ষুদ্র এই সময়ের ব্যবধান নির্ণয় করা হয় এটমিক ক্লক বা আণবিক ঘড়ির সাহায্যে। এটমিক ক্লক হল সময় নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে নির্ভুল যন্ত্র। এইসব ঘড়ি এক সেকেন্ডের কোটি ভাগ সময় ও নির্ণয় করতে পারে। রিসিভারের সাধারণত এটমিক ক্লক থাকে না। এগুলো শুধুমাত্র স্যাটেলাইটেই সংযুক্ত থাকে। চারটি স্যাটেলাইট থেকে যখন একটি রিসিভারের দূরত্ব জানা যায় তখনই GPS মাধ্যমে নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
GPS স্যাটেলাইট এবং রিসিভার যে অবস্থান নির্ণয় করে আমরা সাধারন মানুষ তার সহজে বুঝতে পারব না। কারণ জিপিএস শুধু কো-অর্ডিনেট পয়েন্ট চিহ্নিত করে। আর গুগল ম্যাপ এর মত সফটওয়্যার গুলো সেই পয়েন্টে বিভিন্ন জায়গার নাম দিয়ে আমাদের কাছে সহজভাবে উপস্থাপন করে। আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯৭০ এর দশকে জিপিএস প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। তাদের এই স্যাটেলাইট ব্যবস্থার নাম ন্যাপস্টার GPS। ১৯৭৪ সালের প্রথম ন্যপস্টার স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। GPS ব্যবস্থা কার্যকর করতে ১৯৮৯ সাল থেকে চব্বিশটি স্যাটেলাইটের ব্যবহার শুরু হয়েছে। GPS এর সমগ্র ব্যবস্থা দেখাশোনার জন্য পৃথিবীতে মোট 30 টি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া সৈন্যদের খুঁজে বের করতে কিংবা দূর থেকে নির্ভুলভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো সহ সামরিক প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করাই ছিল এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। ১৯৯৫ সালে ব্যবস্থাটি বিনামূল্যে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তবে GPS ই একমাত্র গ্লোবাল নেভিগেশন সিস্টেম নয়। যেহেতু এই প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মালিকানাধীন তাই তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া নিজেদের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। যার নাম Glonass বা গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম। এছাড়া চীনের BeiDou এবং ভারতের Navic প্রায় একই ধরনের কাজ করে। তবে সমগ্র বিশ্বের সিংহভাগ ডিভাইসে আমেরিকার GPS থাকার কারণে এখনো পর্যন্ত এর প্রতিদ্বন্দ্বি কেউ নেই বললেই চলে।
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং, ঘরে বসে খাবার অর্ডার করা কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ এর মাধ্যমে লেনদেন করার মতো বহু জরুরি কাজে আমরা GPS ব্যবহার করছি। কিন্তু এর বাইরেও যে GPS এর কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার আছে তা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। সমগ্র বিশ্বের ব্যাংকিং লেনদেন স্টকমার্কেট বিদ্যুৎ বিল ডিজিটাল টেলিভিশন স্টেশন এর মত অবকাঠামো GPS এর উপর নির্ভরশীল। GPS ছাড়া আধুনিক বিশ্বের যোগাযোগ লব্যবস্থা কল্পনাই করা যায় না। সামরিক বিমান থেকে শুরু করে সাধারণ যাত্রীবাহী বিমান এবং সমুদ্রগামী জাহাজ গুলো GPS ব্যবহার করেই আকাশে কিংবা মহাসাগরে পথ চিনে নেয়। আধুনিক এই GPS ব্যবস্থা আসার পর থেকে দুর্ঘটনা ব্যতীত কোন বিমান বা জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার খবর নেই বললেই চলে। এমনকি এই ব্যবস্থায় আপনি চাইলেও হারিয়ে যেতে পারবেন না। ১৯৯৬ সাল থেকে মোটর গাড়িতেও GPS এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর ফলে সড়ক পথে পণ্য পরিবহন কোম্পানিগুলো তাদের মালামাল এই মুহূর্তে কোথায় আছে তার সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে পারছে। এছাড়া GPS ব্যবহারের ফলে বিশ্বব্যাপী গাড়ি চুরি ঠেকানো গেছে উল্লেখযোগ্যহারে।
INFOLINK TRACKER বাংলাদেশে সফল ভাবে এই সেবাটি প্রদান করে আসছে। ইনফোলিংক লিমিটেড এর জিপিএস ভিত্তিক ট্র্যাকিং ব্যবহার করে আপনার গাড়ি এবং মূল্যবান সম্পদ এর উপর নজরদারি করতে পারবেন খুব সহজেই।