5G নেটওয়ার্ক কেনো তৈরি করা হয়েছে এবং এর কাজ কি

 

আসসালামু আলাইকুম। আজকের টপিক হচ্ছে 5G নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। এটি কিভাবে কাজ করে। এর মাধ্যমে মানুষ কি কি সুফল পেতে পারে। 5G আমাদের জীবনে যেসব বিপ্লব বয়ে নিয়ে আসবে এ সম্পর্কে আজকের টপিকে আলোচনা করা হবে।

 

নামকরণ

 

মোবাইল ইন্টারনেটের বেলায় 2G, 3G বা 4G এর কথা আমরা অনেক শুনেছি। সম্প্রতি বাংলাদেশে 5G চালু হয়েছে। 1,2,3 এরকম সংখ্যার পরে G দিয়ে মূলত বুঝায় জেনারেশন। সময়ের সাথে সাথে মোবাইল পরিসেবা এবং তারহীন ইন্টারনেটের অনেক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হয়েছে। সেসব প্রযুক্তির বৈজ্ঞানিক নাম হয়তো সবাই বুঝবে না। তাই এগুলোকে এক একটি প্রজন্ম বা জেনারেশন হিসেবে নামকরণ করা হয়। 5G নেটওয়ার্ক প্রচলিত 4G নেটওয়ার্ক এর তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন। 5G রেসপন্স টাইম হবে মানুষের চোখের পলক পড়ার চেয়েও ৪০০ গুণ দ্রুত। বিশ্বব্যাপী ওয়ারলেস ইন্টারনেটের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হতে যাচ্ছে 5G নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে।

 

 

5G নেটওয়ার্ক কেনো তৈরি করা হয়েছে

 

মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো 1G নেটওয়ার্ক দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। তখন শুধু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কথা বলা যেত। এরপর আসে 2G। যার সাহায্যে প্রথমবারের মতো দুটি মোবাইল ডিভাইসের মধ্যে টেক্সট মেসেজ আদান-প্রদান করা সম্ভব হয়। তারপর 3G নেটওয়ার্ক কল করা, টেক্সট মেসেজ এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে আরো সহজে ব্যাবহার উপযোগী করে। 4G নেটওয়ার্কে 3G এর সুযোগ-সুবিধাগুলোই ছিল শুধু তার সাথে যোগ করা হয়েছে বাড়তি গতি। যাতে করে মোবাইলের মাধ্যমে বড় বড় ফাইল ট্রান্সফার করা যায় এবং অনেকগুলো ডিভাইস সহজে কানেক্ট করা যায়। ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের ফলে 4G এর চেয়ে দ্রুতগতির নেটওয়ার্ক সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

 

 

5G নেটওয়ার্ক কে প্রথম চালু করেছে

 

5G নেটওয়ার্ক কারা প্রথম চালু করেছে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়া দাবি করে তারা আমেরিকা এবং চীন কে পিছনে ফেলে সবার আগে 5G নেটওয়ার্ক হ্যান্ডসেট এর মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকার AT&T এবং VERIZON কমিউনিকেশন দাবি করে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েক মাস আগে 5G নেটওয়ার্ক চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। যদিও আমেরিকায় প্রথম 5G ব্যবহার করা হয়েছিল মোবাইল হটস্পট ডিভাইস ব্যবহার করে।কোনো 5G ফোনের সাহায্যে নয়। এই প্রযুক্তিতে কারা এগিয়ে থাকছে তা ব্যবসায়িক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০৩৫ সালের মধ্যে 5G নেটওয়ার্ক থেকে প্রায় সাড়ে ১২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে।

 

5G নেটওয়ার্ক এর গতি

 

5G নেটওয়ার্ক এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একটি অতি উচ্চগতির ইন্টারনেট। 3G তে ইন্টারনেট স্পিড ছিল মাত্র 2 mbps এবং 4G ইন্টারনেটের গতি ছিল 30 mbp। 5G এর গতি হবে সর্বনিম্ন 60mbps- 1gbps পর্যন্ত। সাধারণ 5G নেটের গতি 4G এর চেয়ে ২০ গুন দ্রুত। তবে কিছু ক্ষেত্রে 5G দিয়ে ১০০ গুণ বা তারও বেশি গতি অর্জন করা সম্ভব। আরো সহজ করে বলতে গেলে দুই ঘণ্টার একটি সিনেমা 3G তে ডাউনলোড করতে সময় লাগবে ২৬ ঘণ্টা 4G তে সময় লাগে ৬ মিনিট এবং 5G তে সময় লাগে ৩.৬ সেকেন্ড। শুধু ইন্টারনেটের গতি পরিবর্তন করাই নয়, 5G নেটওয়ার্ক এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রেসপন্স টাইম। 4G নেটওয়ার্ক আমাদের কোন কমান্ড রেসপন্স করতে ৫০ মিলিসেকেন্ড সময় নেয়। 5G এর রেসপন্স টাইম হবে ০১ মিলিসেকেন্ড। মজার ব্যাপার হলো মানুষের চোখের পলক পড়তেও ১০০-৪০০ মিলিসেকেন্ড সময় লাগে। তার মানে 5G এর রেসপন্স টাইম চোখের পলক পড়ার চেয়েও ৪০০ গুণ দ্রুত। এখনো পর্যন্ত ৬১ টির বেশি দেশে 5G নেটওয়ার্ক চালু করা হয়েছে। বর্তমানে শীর্ষ গতির 5G এর সেবা সম্পন্ন দেশগুলো হলো দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সৌদি আরব, দুবাই এবং জাপান।

 

 

5G নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ক্ষেত্র

 

5G ব্যবহারের একটি বড় ক্ষেত্র হলো Internet of things (IOT)। বাংলায় যাকে বলা হয় জিনিসপত্রের ইন্টারনেট। আরো সহজ করে বলতে গেলে বলা চলে এখন থেকে শুধু মোবাইল ফোন ছাড়াও আমাদের বাসা বাড়ির প্রতিটি বৈদ্যুতিক ডিভাইস একে অপরের সাথে কানেক্টেড থাকবে। যেমন আপনার বাড়ির লাইট, ফ্যান, টেলিভিশন, রাইস কুকার, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থাকবে। আপনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সেলফ ড্রাইভিং কার বা স্বচালিত গাড়ির কথা আমরা অনেকে শুনেছি। বহু কোম্পানি ইতোমধ্যে self-driving গাড়ী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এমনকি বহু গাড়ি বাজারে এসেছে। এসব গাড়ি নির্ভুলভাবে কাজ করার জন্য উচ্চগতির ইন্টারনেট এর সাথে নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ থাকতে হবে। তা না হলে কয়েক মিলি সেকেন্ডের ব্যবধানে মারাত্মক প্রাণঘাতি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। 5G ইন্টারনেট ব্যবহার করে মেটাভার্স এবং স্মার্ট সিটির মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও বাস্তবে পরিণত হতে পারে। 5G ইন্টারনেট ব্যবহার করে মেটাভার্স এবং স্মার্ট সিটির মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও বাস্তবে পরিণত হতে পারে।এরকম নানান ক্ষেত্রে পরবর্তীত ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে 5G নেটওয়ার্ক।

 

 

5G নেটওয়ার্ক এর সুবিধা

 

5G শুধু মোবাইল ইন্টারনেটেই নয় হয়তো বা হোম ইন্টারনেটেও জায়গা দখল করে নিতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করা অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু 5G নেটওয়ার্ক এর সাহায্যে শহর থেকে গ্রাম সবখানেই অতি দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া সম্ভব। 5G এর আরেকটি বড় সুবিধা হল এ প্রযুক্তি অনেক কম এনার্জি খরচ করে চলতে পারে। 5G শুধু মোবাইল ইন্টারনেটেই নয় হয়তো বা হোম ইন্টারনেটেও জায়গা দখল করে নিতে পারে। তার মানে আমাদের স্মার্টফোনসহ সকল ধরনের ডিভাইসে আগের চেয়ে অনেক কম চার্জ ফোরাবে।

 

 

ব্যয়বহুল 5G নেটওয়ার্ক

 

5G প্রযুক্তির সম্ভাবনা গুনে শেষ করা সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে হয়তো ভবিষ্যতের সকল ধরনের তারের সংযোগ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে 5G নেটওয়ার্ক এর খুব বেশি বিস্তার লাভ করার সম্ভাবনা নেই। কারণ শুরুর দিকে 5G নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা খানিকটা কঠিন এবং ব্যয়বহুল। 3G থেকে যখন 4G তে অপারেট করা হয় তখন পরিচালিত অবকাঠামো ব্যবহার করেই আপডেট করা সম্ভব করা হয়েছিল। কিন্তু 5G এর জন্য অনেক বেশি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির ব্যান্ডউইথের দরকার। ফলে নতুন করে অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য দরকার আরও উন্নত মোবাইল টাওয়ার এবং অতি আধুনিক যন্ত্রপাতি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন 5G নেটওয়ার্ক এর অতিরিক্ত খরচ কমানোর জন্য একাধিক মোবাইল অপারেটর কোম্পানি একসাথে কাজ করার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

 

 

5G নেটওয়ার্ক এর অসুবিধা

 

5G নেটওয়ার্ক এর একটি বড় অসুবিধা হলো টাওয়ার এবং ডিভাইস এর মাঝে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে নেটওয়ার্কের স্পিড অনেক কমে যায়। এমনকি বৃষ্টির কারণে 5G নেটওয়ার্ক বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সে জন্য সাধারণ মোবাইল টাওয়ার এর চেয়ে অনেক বেশী 5G টাওয়ার স্থাপন করতে হবে। এছাড়া 5G নেটওয়ার্ক উড়োজাহাজের যন্ত্রপাতির কর্মক্ষমতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সম্প্রতি বিশ্বের দুই বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান Boeing এবং Airbus আমেরিকার সরকারকে 5G প্রযুক্তি প্রচলনে বিলম্ব করার অনুরোধ করেছ।

 

 

বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা

 

বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা নেই এমন লোক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।সত্যিকারভাবে বাংলাদেশে 4G ইন্টারনেট প্রকৃত 4G নয়। ইন্টারনেট সেবা প্রদানের দিক থেকে বাংলাদেশ মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো বহুগুণ পিছিয়ে আছে। লজ্জার বিষয় হলো মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক থেকে ১৩৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৩ তম। এ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু আফগানিস্থান। অথচ টেলিভিশন থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যম সমূহ সর্বত্র মোবাইল অপারেটরদের অতিরঞ্জিত বাহারি সব বিজ্ঞাপনে মানুষ অতিষ্ঠ। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে এই দুর্বল ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপন না দিয়ে তারা যদি এই টাকাগুলো ইন্টারনেট উন্নয়নে ব্যয় করত তাতেও বোধহয় বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেট খানিকটা সামনে এগিয়ে যেত। মোবাইল ইন্টারনেটের তুলনায় বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বেশি এগিয়ে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতির বিচারে 138 টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান 98 তম।

 

Leave a Comment